গুড়ের পুষ্টিতথ্য
[প্রবন্ধের মূল উৎস MyUpchar বাংলা, পরবর্তীতে পরিমার্জিত]
গুড় হল এক ধরণের মিষ্টিকারক যা খেজুরের রস এবং আখ থেকে তৈরি করা হয়। এটিকে চিনির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে ধরা হয় কারণ এটি অপরিশোধিত (unrefined)। যদিও চিনি এবং গুড়ে সমপরিমাণ ক্যালোরি থাকে, কিন্তু গুড়কে তুলনামূলকভাবে বেশি ভাল মনে করা হয় কারণ এতে ভিন্ন প্রকারের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়।
গুড় সাধারণত তিন ধরণের পাওয়া যায়- শক্ত (পাটালি), তরল (ঝোলা) এবং এই দুয়ের মাঝামাঝি (দানা)। তরল গুড় গ্রামাঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়, আবার শক্ত গুড় সবরকম লোকজনের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। গুড় বিভিন্ন রঙের হয় এবং এটি সোনালী বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী রঙের হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল যে গুড় যত গাঢ় হবে ততটাই কড়া এবং মিষ্টি হবে এর স্বাদ।
দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গুড় খাওয়া হয়। গুড় ব্যাপকভাবে নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার স্থানীয় রান্নায় ব্যবহৃত হয় এবং এটি ভারতীয় রন্ধনশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। গুড় ব্যবহার করা হয় মিষ্টি, পানীয়, চকলেট, ক্যান্ডি, টনিক, সিরাপ, শরবত, কেক ইত্যাদি তৈরি করতে। মহারাষ্ট্র সারা বিশ্বে গুড়ের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। আমেরিকা, এশিয়া, এবং আফ্রিকায় বৃহৎ পরিমাণে গুড় খাওয়া হয়। আখের গুড়, খেজুরের গুড়, তালের গুড়, ইত্যাদির মত বিভিন্ন ধরণের গুড় পাওয়া যায়।
গুড়ের প্রচুর স্বাস্থউপকারিতা রয়েছে। আয়ুর্বেদিক এবং প্রথাগত চিকিৎসায় গুড়ের একটি বিশিষ্ট জায়গা আছে। আয়রন সমৃদ্ধ হবার কারণে এটি রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে। খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণে গুড় খেলে তা আপনার হজমে সাহায্য করে বলে জানা যায়। মরিচের সাথে গুড় খেলে তা আপনার খিদে বাড়ায়। আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, গুড়ের নিয়মিত সেবন আপনার দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। গুড় ব্রণ নিরাময় করে এবং শারীরিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। খনিজ লবণের সাথে গুড় খেলে চোয়া ঢেকুর সারানো যায়।
গুড়ের ব্যপারে কিছু মৌলিক তথ্যঃ
- বোটানিক্যাল নামঃ গুড় হল আখের অর্থাৎ সাখারাম অফিসিনারাম-এর একটি উপজাত পণ্য।
- পরিবারঃ পোয়াসি (আখের জন্য)
- প্রচলিত নামঃ গুড়
- সংস্কৃত নামঃ গুড়/শর্করা
- স্থানীয় অঞ্চল এবং ভৌগোলিক বণ্টনঃ কিছু লোক বিশ্বাস করেন যে গুড়ের জন্ম পূর্ব ভারতে, আবার অন্য কিছু লোক বিশ্বাস করে যে পর্তুগিজরা এটি ভারতে প্রবর্তিত করেছিল। বাংলাদেশ, ভারত,পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা হল বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গুড় উৎপাদক।
- মজাদার তথ্যঃ গুড়কে প্রায়শই “সর্বোত্তম খাদ্য মিষ্টিকারক” superfood sweetener হিসেবে উল্লিখিত হয়।
গুড়ের পুষ্টিগুনের তথ্য
এটি নিজের অধিকাংশ খনিজ বস্তু ধরে রাখে, যা সাদা পরিমার্জিত চিনির মত নয়। USDA পুষ্টিগুণের ডেটাবেস অনুযায়ী, ১০০গ্রাম গুড়ে নিম্নলিখিত উপাদানগুলি রয়েছেঃ
পুষ্টিগুন | মুল্য প্রতি 100 গ্রাম |
শক্তি | 375 কিক্যাল |
কার্বোহাইড্রেট | 92.86 গ্রা |
চিনি | 85.71 গ্রা |
খনিজ বস্তু | |
ক্যালসিয়াম | 29 মিগ্রা |
লোহা | 2.57 মিগ্রা |
সোডিয়াম | 36 মিগ্রা |
গুড়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা
গুড় একটি দুর্দান্ত মিষ্টিকারক, যা প্রচুর স্বাস্থউপকারিতাও যোগায়। আসুন দেখে নেওয়া যাক গুড়ের কিছু প্রমাণ ভিত্তিক স্বাস্থপকারিতা।
- উচ্চ পরিমাণে খনিজ বস্তুঃ গুড় লোহা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক এবং ফসফরাসের মত খনিজ বস্তুতে ঠাসা। অপুষ্ট লোকজনের মধ্যে গুড় হল সাদা চিনির একটি আদর্শ বিকল্প।
- হিমোগ্লোবিন উন্নত করেঃ গুড় হল আয়রনের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং সেহেতু এটি এমন একটি দুর্দান্ত ফুড সাপ্লিমেন্ট যা হিমোগ্লোবিন উন্নত করে রক্তাল্পতা আক্রান্ত ব্যক্তিদের হিমোগ্লোবিন বর্ধিত করে। মহিলা এবং কিশোরী মেয়েদের মধ্যে দৈনিক গুড়ের সেবন প্রস্তাবিত করা হয় রক্তাল্পতা রোধ করতে।
- রক্তের শুদ্ধিকরণঃ গুড়ের একটি বিষনাশক প্রভাব রয়েছে। এটি শরীরের বিষক্রিয়া দূর করে এবং যকৃৎ ও অগ্নাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করে।
- মস্তিষ্কের ক্রিয়া উন্নত করেঃ গুড়ে বেশ ভাল পরিমাণে ম্যাঙ্গানীজ পাওয়া যায়, যা মস্তিষ্কের সংকেত ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত করার জন্য দায়ী। গুড় খেলে আপনার স্মৃতিশক্তি এবং চেতনা শক্তিশালী হয় এবং স্নায়বিক ক্ষয় প্রতিরোধ করে।
- ওজন কমাতে সাহায্য করেঃ আপনি যদি খানিকটা ওজন কমাতে চান, চিনির অত্যন্ত ভাল বিকল্প হতে পারে গুড়। চিনির বিপরীত ধর্মী হিসেবে, গুড়ে থাকা ক্যালোরি স্বাস্থ্যবর্ধক ভিটামিন এবং খনিজ বস্তু দিয়ে তৈরি এবং গুড় বিপাকীয় কার্যকলাপ উন্নত করে বলে দেখা গেছে, যার ফলে ওজন কমে।
- মহিলাদের জন্য উপকারিতাঃ গুড় মহিলাদের মধ্যে রক্ত প্রবাহ উন্নত করে এবং মাসিকের সময় হওয়া সঙ্কুছন কমায়। লোহা এবং ক্যালসিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস হওয়ার দরুন এটি হাড়ের সংরক্ষণ করে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে।
গুড়ে খনিজের পরিমাণ
গুড় লোহা, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মত খনিজে সমৃদ্ধ। এতে ন্যায্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক এবং ফসফরাস রয়েছে। যেহেতু গুড় অপ্রক্রিয়াজাতকৃত হয়ে থাকে, তাই এই সকল খনিজ এবং ভিটামিন অক্ষত থাকে, যেকারণে এটি সাদা চিনির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে গণ্য হয়। সব গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং খনিজ বস্তু থাকার কারণে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটি মিষ্টিকারক হিসেবে একটি আদর্শ পছন্দ।
গুড়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য
অক্সিডেটিভ চাপ তখন হয় যখন শরীর ফ্রি র্যাডিকাল (প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি) থেকে হওয়া ক্ষতিকারক প্রভাব আটকাতে পারেনা। এটি একটি ঝুঁকির কারণ হতে পারে ক্যানসার, বাত এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ক্ষেত্রে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দায়ী ফ্রি র্যাডিকালের ক্ষতিকারক প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য, ফলতঃ তাদের রোগের কারণ হতে বাধা দেয়। গবেষণা অনুযায়ী গুড় ম্যাগনেসিয়ামে সমৃদ্ধ এবং সেলেনিয়ামের সাথে এটি ফ্রি-র্যাডিকাল থেকে হওয়া ক্ষতি আটকায়। এভাবে এটি শরীরের অনাক্রম্যতা বাড়িয়ে বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণ রোধ করে। আরেকটি গবেষণা প্রদর্শিত করে যে গুড়ে প্রয়োজনীয় ফেনলিক অ্যাসিড রয়েছে যেটিকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে 97% সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে।
গুড়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- ডায়বিটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে
গুড় একটি মিষ্টিকারক। যে কোন মিশ্তিকারক অতিরিক্ত পরিমাণে খেলেই তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ডায়বিটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বা যাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খাওয়া সুপারিশ করা হয় না। আয়ুর্বেদ, যা গুড়ের বিভিন্ন স্বাস্থপকারিতার জন্য গুড় খাওয়া সুপারিশ করে, ডায়বিটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গুড় না খাওয়ার পরামর্শ দেয়। - সংক্রমণ ঘটাতে পারে
খাওয়ার আগে গুড়ের পরিষ্কার কি না খেয়াল করা প্রয়োজন। গুড় যদি সঠিকভাবে সাফ না করা হয়, তাহলে তা স্বাস্থ্যের জটিলতার রূপ নেয়। যখন এটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়, তখন এই গুড়ে বিভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু থেকে যায়। গুড়ে ভেজাল মেশানো খুবই সাধারণ যখন বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় এটিকে আকর্ষণীয় দেখাবার জন্য। সুতরাং এমন একটি জায়গা থেকে গুড় কেনা উচিৎ যেটি নির্ভরযোগ্য। - ওজন বাড়ায়
গুড় পরিশোধিত সাদা চিনির চেয়ে ভাল। কিন্তু বৃহৎ পরিমাণে গুড় খাওয়ার ফলে ক্যালোরি বাড়ে, যার ফলে ওজন বাড়তে পারে। - অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অনেকে বিশ্বাস করেন যে অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খেলে তা ক্রমে কোষ্ঠকাঠিন্যের রূপ নিতে পারে এবং অ্যালার্জির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা চিহ্নিত হয় চর্মরোগ, বমির ভাব এবং জ্বরের দ্বারা।
উপসংহার
গুড় এমন একটি মিষ্টান্ন যা তার উৎস ফলের অধিকাংশ খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন বজায় রাখে। গুড় ওজন কমাতে সাহায্য করে, ঋতুস্রাবের কষ্টকর লক্ষণগুলির প্রতিরোধ করে, এটি স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকলাপে সহায়তা করে এবং এর হাঁপানি-বিরোধী ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যদিও অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খেলে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের রূপ নিতে পারে এবং ওজন বাড়াতে পারে। আর ডায়বিটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যও এটি আদর্শ সুইটেনার নয়।
এমন একটি নিরাপদ জায়গা থেকেই গুড় কেনা উচিৎ যেটি আনরিফাইন্ড গুড় বিক্রয় করে। সকল উপকারিতা বিবেচনায় এটিকে সাদা চিনির ভাল বিকল্প হিসেবে ধরা হয়।